বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো ধান চাষ, এবং শীতকালীন বোরো মৌসুম (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) এতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই মৌসুমে ধানের বীজতলা তৈরি করা হয় চারা উৎপাদনের জন্য, যা পরে মূল খেতে রোপণ করা হয়। কিন্তু শীতের তীব্র ঠান্ডা, কুয়াশা এবং শিশিরের কারণে বীজতলায় নানা সমস্যা দেখা দেয়—যেমন চারা হলুদ বা সাদা হয়ে যাওয়া, বৃদ্ধি থেমে যাওয়া, পাতা শুকিয়ে যাওয়া বা রোগের আক্রমণ। এসব সমস্যা যদি সময়মতো না সামলানো হয়, তাহলে চারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুরো ফসলের উৎপাদন কমে যায়। আজকের এই ব্লগে আমরা শীতকালীন ধানের বীজতলার সঠিক পরিচর্যা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, বিশেষ করে ঠান্ডা-সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর কারণ এবং সহজ, ব্যবহারিক সমাধান। এই লেখাটি বাংলাদেশের স্থানীয় আবহাওয়া, মাটি এবং কৃষকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যাতে আপনারা সহজেই প্রয়োগ করতে পারেন এবং ভালো ফলাফল পান। চলুন শুরু করি!
![]()
শীতকালীন ধানের বীজতলা
বোরো ধানের বীজতলা সাধারণত একটি ছোট, উঁচু জমির অংশে তৈরি করা হয়, যেখানে ধানের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ৩০-৪৫ দিন পর্যন্ত চারা বড় করা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বা ঠান্ডা-প্রবণ এলাকায় এই মৌসুমে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে যায়, যা চারার বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। সাধারণত, বীজতলা রোদযুক্ত, ছায়াহীন জায়গায় তৈরি করতে হয় এবং মাটিতে জৈব সার (যেমন গোবর) মিশিয়ে পুষ্টিকর করে নিতে হয়। কিন্তু শীতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ঠান্ডা-জনিত সমস্যা, যা আমরা নিচে বিস্তারিত দেখব।
শীতকালীন বীজতলার প্রধান সমস্যা এবং কারণসমূহ শীতের ধানের বীজতলায় সমস্যা মূলত আবহাওয়া-সম্পর্কিত, যেমন তীব্র ঠান্ডা, কুয়াশা এবং পুষ্টি অভাব। এখানে কয়েকটি সাধারণ সমস্যা ও তার সমাধান নিচে উল্লেখ করা হলো
১, চারা হলুদ বা সাদা হয়ে যাওয়া এবং বৃদ্ধি থেমে যাওয়া
এটি সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। কারণ: অতিরিক্ত ঠান্ডায় চারার শিকড়ের কার্যক্ষমতা কমে যায়, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য পুষ্টির শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে চারা দুর্বল হয় এবং রঙ হারায়।
সমাধানের উপায়: চারা হলুদ বা সাদা হলে দ্রুত ইউরিয়া ও গন্ধক সালফার যেমনঃ থিয়োভিট এবং (ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম) অথবা ম্যানকোজেব ছত্রাকনাশক যেমনঃ ম্যানসার ৭৫ ডব্লিউপি, কারমিক্স ব্লু ৭৫ ডব্লিউপি, ওজেব ব্লু ৮০ ডব্লিউপি, টাইকোজেব ৮০ ডব্লিউপি ইত্যাদি এর ভিতর যেকোনো ১ টি পানিতে মিশিয়ে স্প্রে দিন। তাহলে গাছের পাতা সবুজ হবে এতে গাছের উপর একটি নিরাপত্তা স্তর তৈরি হয় তাই শিতে গাছ কম ক্ষতিগ্রস্থ হবে গাছ দ্রুত বড়ো হবে।
২, পাতা শুকিয়ে যাওয়া বা ব্লাইট রোগের আক্রমণ
কুয়াশা এবং শিশির জমে থাকায় ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বাড়ে, যা ঠান্ডায় আরও তীব্র হয়।
সমাধানের উপায়: পাতা শুকিয়ে যাওয়া বা ব্লাইট রোগের আক্রমণ হলে (ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম) যেমনঃ ম্যানসার ৭৫ ডব্লিউপি, কারমিক্স ব্লু ৭৫ ডব্লিউপি, ওজেব ব্লু ৮০ ডব্লিউপি, টাইকোজেব ৮০ ডব্লিউপি ইত্যাদি এর ভিতর যেকোনো ১ টি পানিতে মিশিয়ে স্প্রে দিন। তাহলে ধানের পাতায় নতুন করে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না এবং পাতা ঠিক হবে এতে গাছের উপর একটি নিরাপত্তা স্তর তৈরি হবে
৩, চারা বসে যাওয়া বা মরে যাওয়া
রাতের ঠান্ডায় মাটির তাপমাত্রা কমে যায়, যা চারার বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।
সমাধানের উপায়: ধানের চারা বসে যাওয়া বা মরে গেলে দ্রুত গন্ধক সালফার যেমনঃ থিয়োভিট ৮০ অথবা সাথে (ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম) অথবা ম্যানকোজেব ছত্রাকনাশক যেমনঃ ম্যানসার ৭৫ ডব্লিউপি, কারমিক্স ব্লু ৭৫ ডব্লিউপি, ওজেব ব্লু ৮০ ডব্লিউপি, টাইকোজেব ৮০ ডব্লিউপি ইত্যাদি এর ভিতর যেকোনো ১ টি বীজ তলায় ছিটিয়ে দিন । তাহলে এই বসা ধান গাছ ঠিক হবে এবং বেড়ে উঠবে।
শীতকালীন ধানের বীজতলাকে বিভিন্ন সমস্যা ও রোগ রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা
উপরের ধানের বীজ তলার বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এই সমস্যা থেকে অগ্রিম ভাবেই প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা যাই যদি নিদ্রিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যাই এই বিশেষ পদ্ধতি ও পদক্ষেপ নিচে উল্লেখ করা হলো
![]()
১. প্রতিরোধমূলক যত্ন: বীজতলা তৈরির সময় থেকে শুরু করুন
- রোদযুক্ত স্থানে বীজতলা নির্মান: বীজতলা যদি রোদযুক্ত, ছায়াহীন জায়গায় তৈরি করুন। অতিরিক্ত ঘন করে বীজ ছড়াবেন না, যাতে চারা একে অপরকে ছায়া না দেয়।
- শুকনো বীজতলা পদ্ধতি ব্যবহার করুন: অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে উপরে ঝুরঝুরে মাটি ছিটিয়ে দিন এবং পুরো বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখুন। এটি ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে এবং চারার বৃদ্ধি ভালো হয়।
- পানি ব্যবস্থাপনা: বীজতলায় সবসময় ২-৫ সেন্টিমিটার পানি রাখুন, কিন্তু অতিরিক্ত না। রাতে বীজতলা পানিতে ডুবিয়ে দিন (যাতে ঠান্ডা কম লাগে) এবং সকালে পানি বের করে দিয়ে নতুন পানি দিন। এটি জমে থাকা ঠান্ডা পানি দূর করে এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
শিশির এবং কুয়াশা দূর করা: সকালে রশি বা লাঠি টেনে চারার উপর জমা শিশির ঝরিয়ে ফেলুন। এটি কুয়াশার কারণে সৃষ্ট আর্দ্রতা কমায় এবং চারা শুকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। - পলিথিন ঢাকা: তীব্র ঠান্ডায় রাতে বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখুন এবং সকাল ৯-১০টায় খুলে দিন। এটি মাটির তাপমাত্রা ধরে বিজতলা কিছুটা গরম রাখে এবং চারাকে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে।
- অগ্রিম ভাবে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ: অগ্রিম ভাবে ম্যানকোজেব বা ম্যানকোজবে + কার্বেন্ডাজিম ছত্রাকনাশক বীজতলায় ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে গাছের পাতার উপর একটি নিরাপত্তা পরদ তৈরি হয় ধান চারা গোল গোল বসে যায় না , এতে ধান চারা নিরাপদ থাকে।
![]()
২. পুষ্টি অভাব থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা
- যদি চারা হলুদ হয়ে যায়: প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করুন। এরপরও সবুজ না হলে ১০ গ্রাম জিপসাম (গন্ধক সার) প্রয়োগ করুন।
- পটাশ অভাব হলে: ১০ গ্রাম/লিটার হারে পটাশ সার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
- রোগের আক্রমণ (যেমন ব্লাস্ট বা ব্লাইট): বেশি ঠান্ডা এবং কুয়াশায় মাত্রানুযায়ী ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম (ছত্রাকনাশক) স্প্রে করুন। চারা তোলার ১ সপ্তাহ আগে কীটনাশক (যেমন ম্যানকোজেব) প্রয়োগ করুন।
- চারা গজানোর ২ সপ্তাহ পর প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং গন্ধক সালফার যেমনঃ মাইক্রথিয়ল, থিয়োভিট, গেইভেট প্রয়োগ করুন যাতে চারা সবুজ এবং সতেজ থাকে।
![]()
অতিরিক্ত টিপস: সফলতার জন্য
- প্রতিদিন সকালে বীজতলা পরিদর্শন করুন এবং সমস্যা দেখলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিন।
- রোপণের জন্য ৩৫-৪০ দিনের চারা ব্যবহার করুন, যাতে তারা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে।
- যদি সম্ভব, পলি-টানেল ব্যবহার করুন।
শেষ কথা: প্রিয় কৃষকরা, শীতের ধানের বীজতলা পরিচর্যা একটু যত্নশীল হলে আপনার ফসলের উৎপাদন অনেক বাড়বে। এই পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে দেখুন এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। যদি আরও প্রশ্ন থাকে, কমেন্ট করুন। সুস্থ ফসল এবং সমৃদ্ধ কৃষির শুভকামনা ! ধন্যবাদ।