কাজহবে ডটকম – কৃষি সমস্যার নির্ভরযোগ্য সমাধান

Press ESC to close

নারিকেল গাছের ভয়ঙ্কর শত্রু গন্ডার / গোবরে পোকা, এই পোকার সমগ্র পরিচয়, ক্ষয়ক্ষতি ও সমাধান

নারিকেল গাছকে অনেক সময় “স্বর্গীয় গাছ” বলা হয়, কারণ এর প্রতিটি অংশই মানুষের কাজে লাগে। কিন্তু এই উপকারী গাছটির এক ভয়ঙ্কর শত্রু হলো  গন্ডার / গোবরে পোকা (Coconut Rhinoceros Beetle) । এই পোকার আক্রমণে একটি সুস্থ নারিকেল গাছও দ্রুত মরে যেতে পারে। আসুন, এই ক্ষতিকারক পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।  

নারিকেলের গন্ডার / গোবরে পোকা কী? (What is Coconut Rhinoceros Beetle?)  

নারিকেল গাছের গন্ডার / গোবরে পোকা ( বৈজ্ঞানিক নাম:    Oryctes rhinoceros ) এক ধরনের বড় গুবরে পোকা। এদের দেহ চকচকে কালো বা গাঢ় বাদামি রঙের হয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো মাথার উপরের  শিং-এর মতো অংশ , যা গন্ডারের শিংয়ের মতো দেখায়। 

  • আকার: প্রায় ৩৫–৫০ মি.মি. (১.৫–২ ইঞ্চি)  
  • চিহ্নিতকরণ: মাথায় স্পষ্ট শিং, শক্ত খোলসে মোড়া দেহ  

উৎপত্তি: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তবে বর্তমানে বিশ্বের অনেক নারিকেল উৎপাদন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে  

gndar-poka.jpg

কখন এবং কীভাবে এটি নারিকেল গাছে আক্রমণ করে? (When and How it Attacks the Coconut Tree?)  

গন্ডার / গোবরে পোকা মূলত প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় (Adult Beetle) নারিকেল গাছে আক্রমণ করে।  

  • আক্রমণের সময়: সন্ধ্যা ও রাতের বেলা সক্রিয় থাকে। দিনে গাছের গোড়ার পচা অংশ, কম্পোস্ট বা কাঠের গাদায় লুকিয়ে থাকে।  
  • মৌসুম: বর্ষা থেকে শীতকাল (জুলাই–ডিসেম্বর) পর্যন্ত সবচেয়ে সক্রিয়।  
  • আক্রমণের পদ্ধতি: পোকা গাছের কাণ্ড বেয়ে উপরে উঠে কচি কুঁড়ি বা মাজে (Crown) ঢোকে এবং নরম অংশ কেটে খেতে শুরু করে। এতে গাছের ভেতরে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়, যা মারাত্মক ক্ষতি করে।  

নারিকে-গাছের-গণ্ডার-পোকা-05

নারিকেল গাছের গন্ডার পোকা কেমন ক্ষতি করে (What Kind of Damage Does It Cause?)  

এই পোকার আক্রমণের ফলাফল অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। এই পোকার ক্ষতির লক্ষণগুলো হলো:  

  1. গাছে ডাটায় গোলাকার গর্থ: আক্রান্ত পাতাগুলোর ডাটা যখন সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত হয়, তখন তার উপর গোল কালো গর্থ কাটা দাগ দেখা যায়। এটি এই পোকার সবচেয়ে সহজে চেনার উপায়।  
  2. পাতা ছিঁড়ে যাওয়া: সামান্য অল্প ঝড় বা বাতাসে নারিলেক গাছের পাতা বাতাসে সহজেই ছিঁড়ে যায় এবং ঝরে পড়ে। গাছ দেখতে ঝাঁজরা হয়ে যায়, পোকাগুলি পাতাকে V শেপে কেটে দেয়।  
  3. কাণ্ডের বিকৃতি: কান্ড বারবার আক্রমণের ফলে গাছের কাণ্ড বাঁকা হয়ে যেতে পারে।  
  4. ফলন হ্রাস: এর আক্রমনে গাছ যদি নতুন পাতা তৈরি করতে না পারে তাহলে গাছ ফুল ও ফল ধারণ ক্ষমতা হারায়। ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।  

গাছের মৃত্যু: যদি মূল মাজ বা কেন্দ্রীয় কুঁড়িই আক্রমণ করে সুড়ঙ্গ করে তাহলে গাছটি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে গাছটি আর বাঁচতে পারে না এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়। অল্প বয়সী গাছের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা আরও বেশি।  

নারিকেল-গাছে-বিটল-পোকার-আক্রমণ-01
 

নারিকেল গন্ডার / গোবরে পোকা প্রতিরোধের উপায় (How to Prevent This Insect?)  

প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেওয়া হলো:  

  1. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: গাছের মাথা ও বাগান পরিষ্কার রাখুন। পচা কাঠ, জৈব সার বা গোবর গাদা করে রাখবেন না।  
  2. বায়ো-কন্ট্রোল বা জৈব নিয়ন্ত্রণ:  
    • Metarhizium anisopliae নামের উপকারী ছত্রাক (যেমন: Lycomax) পোকার লার্ভা ও পূর্ণবয়স্ক উভয়কেই মেরে ফেলতে পারে ও রোগ সৃষ্টিকারি ছত্রাক দমন করে।  
    • এটি পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ।  
  3. আলোর ফাঁদ ব্যবহার: রাতের বেলা আলোর ফাঁদে পোকা আকৃষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়, তবে বড় বাগানে এটি সীমিত কার্যকর।  

কীটনাশক ব্যবহার করে নারিকেল গন্ডার / গোবরে পোকা নিয়ন্ত্রণ? (How to Kill This Insect with Insecticide?)  

যখন পোকার আক্রমণ তীব্র হয়, তখন কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। নিম্নলিখিত কীটনাশকগুলো ব্যবহার করলে পোকাগুলি দমন হবে:   

কার্যকর কীটনাশকসমূহ:  

  • ক্লোরোপাইরিফস : বাংলাদেশে ক্লোরোপাইরিফস যুক্ত কীটনাশকের নাম মর্টার ৪৮ ইসি, ট্রাফ ৪৮ ইসি  
  • সাইপারমেথ্রিন : বাংলাদেশে ইপারমেথ্রিন যুক্ত কীটনাশকের নাম মেসি ১০ ইসি, সাইপেরিন ১০ ইসি  
  • ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন : বাংলাদেশে ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন যুক্ত কীটনাশকের নাম সাটডাউন ২০ ইসি, বক্সার ২.৫ ইসি, জাগুয়ার ২.৫ ইসি, ডেসিস ২.৫ ইসি  
  • ইমিডাক্লোপ্রিড : বাংলাদেশে ইমিডাক্লোপ্রিড যুক্ত কীটনাশকের নাম গেইন ২০ এসএল, ইমপেল ২০ এসএল, ইমিটাফ ২০ এসএল  

দ্রুত ফলাফল পেতে ক্লোরোপাইরিফস, সাইপারমেথ্রিন বা ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করুন।  

স্প্রে করার সঠিক পদ্ধতি:   

  • এই পোকার জন্য বিকেলের সময় স্প্রে করা সবচেয়ে কার্যকর হয়।  
  • পোকাগুলি শীষ কুড়িতে আক্রমণ করলে গাছের শীর্ষ কুঁড়ি (Crown)-এ স্প্রে করতে হবে, কারণ এটিই পোকার প্রধান আক্রমণের স্থান। গাছ অতিরিক্ত লম্বা হলে গাছে উঠে বিষ যুক্ত পানি গাছে ঢেলে দিতে হবে।  
  • আক্রান্ত পাতায় ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করুন।  
  • স্প্রে করার সময় নিশ্চিত হতে হবে যে পোকাগুলি ওষুধের সংস্পর্শে আসছে।  
  • কীটনাশক ব্যবহারের সময় নির্দেশিত সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন।  

গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ: সব সময় প্রথমে জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতি (ফাঁদ, সংগ্রহ) ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। কীটনাশক হলো শেষ অবলম্বন, কারণ এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং মৌমাছি সহ অন্যান্য উপকারী পোকাকে মেরে ফেলতে পারে।  

Coconut-Rhinoceros-Beetle-04
 

কৃষকের প্রতি পরামর্শ  

  • নিয়মিত নারিকেল গাছের মাথা পরিদর্শন করুন।  
  • এই পোকার জন্য জৈব বালাইনাশক যেমনঃ Lycomax (Metarhizium anisopliae) এজেন্ট ব্যবহার করলে পোকা দমন হয় এবং মাটির রোগজীবাণু মুক্ত হয়।

উপসংহার   

নারিকেল গাছের গন্ডার / গোবরে পোকা নারিকেল চাষের জন্য বড় হুমকি হলেও সচেতনতা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আপনার নারিকেল বাগানকে সুরক্ষিত রাখতে উপরে দেওয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করুন এবং প্রয়োজনে আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। “সঠিক যত্নেই আপনার নারিকেল গাছ থাকবে সবুজ ও ফলনে ভরপুর”  

Related Posts

🌽 ভুট্টার লেদা পোকার আক্রমণ, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
ভুট্টার কাটুই পোকা দমন: লক্ষণ, প্রতিরোধ ও কার্যকর কীটনাশক ব্যবহারের নির্দেশিকা
ধানের জমিতে ইঁদুর দমনের কীটনাশক ঔষধ
কলাকে আরো লম্বা মোটা, চকচকে, স্পট মুক্ত রাখার পদ্ধতি
Rubai Hussain

হাই, এটা মোঃ রুবাই হোসেন আমি হলাম অভিজ্ঞ কৃষি বিষয়ক স্পেশালিস্ট। আমি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কৃষকদের বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ, পোকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। আমার লক্ষ্য হলো কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ কমিয়ে একটি টেকসই এবং লাভজনক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সমন্বয় করে আমি সবসময় কৃষকদের পাশে আছি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *