🌽 ভুট্টার লেদা পোকার আক্রমণ, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি

🌽 ভুট্টার লেদা পোকার আক্রমণ, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি 

ভুট্টা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শস্য, কিন্তু এর উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় লেদা পোকা বা কর্ণ বোরার (Corn borer)। এই ক্ষতিকারক পোকা গাছের কাণ্ড ও গুটির ভিতরে ঢুকে টিস্যু খেয়ে ফেলে, ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। 

চলুন জেনে নিই ভুট্টার লেদা পোকার অজানা দিকগুলো—এর পরিচিতি, আক্রমণের সময়, লক্ষণ, দমন ও প্রতিকার পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে। 

🐛 লেদা পোকার পরিচিতি 

লেদা পোকা বা ফল আর্মিওয়ার্ম (Fall Armyworm) অথবা এর সা দৃশ্য পোকায় আক্রমন করে। লেদা পোকা হলো ভুট্টার সবচেয়ে ভয়ংকর পোকাগুলোর একটি, যা ভুট্টার পাতা, কাণ্ড ও গুটিতে মারাত্মক ক্ষতি করে। এরা মূলত রাতে সক্রিয় থাকে, পাতা কুরে খায় এবং কচি অংশে ঢুকে ভিতরের নরম টিস্যু খেয়ে ফেলে। 

🔹 বাংলা নাম: লেদা পোকা / ফল আর্মিওয়ার্ম 

🔹 ইংরেজি নাম: Fall Armyworm 

🔹 বৈজ্ঞানিক নাম: Spodoptera frugiperda 

🔹 পরিবার: Noctuidae 

👉 কৃষকেরা সাধারণত বলেন — “ লেদা পোকা মাজের ভিতর ঢুকে ভুট্টার গাছ ও ফল নষ্ট করে ” 

🌱 ভুট্টার কত বয়সে লেদা পোকার আক্রমণ হয় 

• সাধারণত ভুট্টা গাছের ২৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে লেদা পোকার আক্রমণ শুরু হয়। 
• এই সময় গাছের কাণ্ড নরম থাকে, ফলে পোকা সহজেই ঢুকে পড়তে পারে। 
• গাছ বড় হলে তারা পাতার গোড়া, কাণ্ড ও কখনো গুটি অংশেও ডিম পাড়ে। 
• উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় (২৫–৩০°সেঃ তাপমাত্রায়) এদের বংশবিস্তার দ্রুত হয়। 

⚠️ লেদা পোকার আক্রমণের লক্ষণ 

লেদা পোকার আক্রমণ চেনার জন্য নিচের লক্ষণগুলো খেয়াল করুন 👇 

• পাতার উপর পোকার গুড়ি গুড়ী পায়খানা দেখা যায়। 
• গাছের পাতায় বা ডগায় ছোট ছিদ্র দেখা যায়। 
• কাণ্ড বা মাজের ভিতর ঢুকে নরম অংশ খেয়ে ফেলে। 
• পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। 
• কাণ্ড কেটে দেখলে ভিতরে গর্ত ও শুঁয়োপোকা দেখা যায়। 

💀 লেদা পোকা দমন না করলে ক্ষতির পরিমাণ 

যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় - 

• ফলন ৩০% থেকে ৮০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। 
• গাছ দুর্বল হয়ে পড়ায় ভুট্টা গুটি অসম্পূর্ণ বা পচে যায়। 
• আক্রান্ত জমিতে পরবর্তী মৌসুমে পোকা থেকে যায়, যা নতুন ফসলেও সংক্রমণ ঘটায়। 
• বীজ উৎপাদনের ক্ষেত হলে বীজের মান নষ্ট হয়, অঙ্কুরোদ্গম কমে যায়। 

🧪 লেদা পোকা দমনের কীটনাশক 

লেদা পোকা দমনে এমামেকটিন বেনজয়েট (Emamectin Benzoate) অথবা লুফেনিউরন অথবা কার্বোসালফান যুক্ত কীটনাশক ব্যবহারে করলে খুভ ভালোভাবে এই পোকা দমন হয়। নিচে এমামেকটিন বেনজয়েটযুক্ত যুক্ত কিটনাশক গুলির নাম দেওয়া হলো 👇 

• রিভা ১০ এসজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ১০ গ্রাম 
• লুমেকটিন ১০ এসজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ১০ গ্রাম  
• জেনটেক ৫ এসজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ১৫ গ্রাম 
• বারুদ ৫ ডব্লিউডিজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ১৫ গ্রাম 
• এক্টর ৬ ডব্লিউজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ১৫ গ্রাম 
• হারকিউলেক্স ৪০ এসজি – প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ৫ গ্রাম 
• আলটিমা প্লাস ৪০ ডব্লিউ জি - প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ৫ গ্রাম 
• ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউডিজি - প্রতি ১৬ লিটার পানির জন্য ৫ গ্রাম 
• হাতিয়ার ৫ ইসি  
• হেরন ৫ ইসি 
• এডভানটেজ ২০ এসসি 
• মারশাল ২০ ইসি 

উল্লেখিত যে কোনো একটি কীটনাশক ভুট্টা ফসলে স্প্রে করলেই পোকা দমন হবে । পোকাগুলি ভালো করে দমন করতে প্রথম স্প্রের ৭ দিন পর ২য় স্প্রে করুন। 

💡 পরামর্শ: 

সন্ধ্যা বেলায় স্প্রে করা সবচেয়ে কার্যকর, কারণ পোকা রাতে সক্রিয় থাকে। 

🛡️ লেদা পোকার প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা 

লেদা পোকার আক্রমণ কমাতে শুধু কীটনাশক নয়, কিছু কৃষি ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা জরুরি 👇 

🔸 আক্রান্ত গাছ ধ্বংস: ক্ষেতে আক্রমণ দেখা দিলে এই পোকা কম সংখ্যায় থাকে তাই আক্রান্ত কাণ্ড গাছ থেকে পোকাগুলি বাছাই করে দমন করা যাই। 

🔸 ফসল ঘুরিয়ে চাষ: একই জমিতে বারবার ভুট্টা চাষ করবেন না। ধান, ডাল বা সবজি ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করুন। 

🔸 জীববৈজ্ঞানিক দমন: ট্রাইকোগ্রামা (Trichogramma) নামক পরজীবী পোকা লেদা পোকার ডিম ধ্বংস করে। এটি ব্যবহার করলে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োজন কমে যায়। 

🔸 সঠিক সেচ ও নিষ্কাশন: অতিরিক্ত আর্দ্রতা পোকা বংশবৃদ্ধি বাড়ায়, তাই জমিতে পানি জমতে দেবেন না। 

🔸 আগাছা পরিষ্কার: আগাছা পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার রাখা জরুরি। 

🌾 কৃষকের জন্য বিশেষ পরামর্শ 

🔸 রোপণের ২০ দিন পর থেকেই ক্ষেত নিয়মিত পরিদর্শন করুন। 

🔸 গাছের ডগা বা পাতায় ছোট ছিদ্র দেখলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিন। 

🔸 প্রাকৃতিক শত্রু পোকার (ট্রাইকোগ্রামা) সংখ্যা রক্ষা করতে অযথা স্প্রে করবেন না। 

🔸 সঠিক মাত্রায় ও সঠিক সময়ে কীটনাশক ব্যবহার করুন। 

📉 উপসংহার 

ভুট্টার লেদা পোকা এমন একটি ভয়ংকর কীট, যা গাছের ভিতর লুকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে গোড়া ও গুটি নষ্ট করে দেয়। সময়মতো দমন না করলে ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। 

তবে সঠিক কৃষি ব্যবস্থাপনা, উন্নত জাত, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই এই পোকার ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।